কে এই শাহজাহান? কেন তার এতো দাপট ?

মানব পাচারেও জড়িত শাহজাহান, দাবি বিরোধীদের

কে এই শাহজাহান? কেন তার এতো দাপট ?

ইডি আধাকিরদের তদন্ত করতে গিয়ে তৃণমূল নেতা শাহজাহানের কর্মী-সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন অফিসারেরা। কিন্তু বেপাত্তা ছিলেন তৃণমূল নেতা শাহজাহান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রায়  তথা ১০ হাজার কোটি টাকার রেশন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তিনি। যার ফলস্বরূপ 'লুকআউট'-এর নির্দেশ জারি করা হয়েছে ইডির তরফে। ইতিমধ্যে প্রত্যেকটি বিমানবন্দর সহ সীমান্তবর্তি এলাকাতে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে এই শাহজাহান ? কেন তার এতো দাপট সন্দেশখালিতে ? প্রশ্ন জেগেছে সাধারণের মনে। 

শাহজাহানের নিজ ঘোষিত সম্পত্তির তালিকাতেই রয়েছে ১৭টি গাড়ি, আড়াই কোটি টাকার গয়না এবং ৪৩ বিঘা জমি! সন্দেশখালির মতো সুন্দরবন লাগোয়া প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা, বছর পঞ্চাশের শেখ শাহজাহান যখন ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনের কাছে হলফনামা দাখিল করেন, তখন জানা গিয়েছিলো, সরবেড়িয়ায় দেড় কোটি টাকার বাড়ি, ব্যাঙ্কে তাঁর জমা টাকার পরিমাণ সে সময়ে ১ কোটি ৯২ লক্ষ ১২ হাজার। এ ছাড়াও, ৪৩ বিঘা জমি যার আনুমানিক মূল্য ৪ কোটি, ১৭টি গাড়ি, ২ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকার গয়না আছে। পেশা হিসেবে শাহজাহান ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছেন হলফনামায়। তবে এই পরিমাণ সম্পত্তির মালিকের শিক্ষাগত যোগ্যতার অংশটি ফাঁকাই রাখা ছিল ভোটপ্রার্থীর আবেদনপত্রে। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া নথিতে শাহজাহান জানিয়েছিলেন, ব্যবসা থেকে বছরে তাঁর আয় ১৯ লক্ষ ৮৩ হাজার ৮৩২ টাকা। তাঁর পরিচিতদের একাংশের কথায়, মেছো ভেড়ির ব্যবসা নিয়ে তিনি বরাবরই বলে থাকেন, নোনা জলে সোনা। এই হলফনামায় অবশ্য শাহজাহানের স্ত্রী তসলিমা বিবির নামে কোনও সম্পত্তি দেখানো হয়নি।

তবে স্থানীয় সূত্রের খবর, সন্দেশখালি এলাকায় শাহজাহানের তিনটি মস্ত বড়ো বাড়ি। শুক্রবার তার একটিতে গিয়েই আক্রান্ত হন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির আধিকারিকেরা। সাদা রঙের একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন শাহজাহানের কয়েক জন আত্মীয়। নীল রঙের বাড়িতেও থাকেন কিছু ঘনিষ্ঠ পরিজনেরা। হলুদ রঙের বাড়িতে থাকেন শাহজাহান। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে তিনটি বাড়িতেই ঝুলছে তালা। বাড়ির পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে বাগান। বাড়ি থেকে বার হওয়ার একাধিক রাস্তা। স্থানীয়দের দাবি, ওই চৌহদ্দিতে আরও কয়েকটি ছোট বাড়ি রয়েছে, যেখানে শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ অনুগামীরা থাকেন।

অন্যদিকে এক তৃণমূল নেতার দাবি করেন, ধামাখালিতে ৪৫ বিঘা জমি নিয়ে দু’টি ইটভাটা করেছেন শাহজাহান। সেখানে রোজই দেখা যেত তাঁকে। প্রায় ৩ বছর আগে বসিরহাটের এক বাসিন্দার থেকে ভাটাগুলি কেনেন তিনি। জেলা পরিষদের একসদস্যের কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটের আগে রেশন দুর্নীতি কাণ্ডে ধৃত বাকিবুর রহমান, মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও শেখ শাহজাহান নানা ধরনের ব্যবসার জন্য পঞ্চাশ বিঘার মতো জমি নিজেদের দখলে নিয়েছেন সন্দেশখালি এলাকায়।

বসিরহাট জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “সন্দেশখালি ১ ও ২ ব্লক ছাড়াও হাড়োয়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা এলাকায় শাহজাহানের আরও সম্পত্তি আছে।” স্থানীয় সূত্রের আরো জানা গেছে, শাহজাহানের নামে ধামাখালিতে ইটভাটা, ন্যাজাটে বাগানবাড়ি, সরবেড়িয়া বাজারে একাধিক দোকান ও নামে-বেনামে মাছের আড়তের কথা শোনা যায়। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, শাহজাহানের এক কোথায় কেনাবেচা চলে মালঞ্চ, আখড়াতলা, ধামাখালির পাঁচটি মাছের আড়তে। মাছের ব্যবসা বাবদ তাঁকে মোটা টাকা ‘নজরানা’ দিতে হয় ব্যবসায়ীদের, অভিযোগ তেমনই রয়েছে। এই এলাকায় আদিবাসীদের কাছ থেকে ৩০০বিঘা জমিও তার দলবল কেড়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ।

স্থানীয়দের অনেকেরই দাবি, সিপিএম ও তৃণমূল, দুই আমল মিলিয়ে শাহজাহান যা সম্পত্তি করেছেন, তার ভগ্নাংশ মাত্র উল্লেখ করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। এই সবের সঙ্গে চোরাপথে মানুষ, গরু, সোনা পাচারেও শাহজাহান জড়িত বলে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ।

তৃণমূল ও সিপিএমের একটি সূত্রের খবর, নির্ভুল বাংলা-ইংরেজি লিখতে পারেন শাহজাহান। ব্যানারে কী লেখা হবে, তার ড্রাফট করেন নিজে। বাম আমলে সন্দেশখালিতে কর্মরত কিছু পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘকালীন যোগাযোগ ছিল শাহজাহানের। সেখানকার জামাত গোষ্ঠীর ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেও তাঁর যোগসূত্র থাকতে পারে বলে এমনি  অভিযোগ রয়েছে।

তৃণমূলের নেতারা কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছেন শাহজাহান প্রসঙ্গে। এক নেতা ফোন ধরে বললেন, “এ সবের মধ্যে আমাদের টানবেন না।”

পাশাপাশি বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সহ-সভাপতি তুহিন মণ্ডল জানিয়েছেন, “বাংলাদেশি শাহজাহানকে নেতা বানিয়েছে বামেরা, আর জনপ্রতিনিধি করেছে তৃণমূল।” সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আহমেদ আলি খান জানান, “তৃণমূল দুষ্কৃতীদের টিকিট দিয়েছে, শাহজাহান তারই প্রমাণ। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের এরাই নানা রকম হুমকি দিয়ে, গায়ের জোরে ভোট করিয়েছে।”

তবে এখন প্রশ্ন উঠেছে কিভাবে শাহজাহান বাম আমল থেকে তৃণমূল আমল পর্যন্ত নিজেকে এভাবে প্রভাবশালী গড়ে তুলেছে ? এর পেছনে কার বা কাদের হাত রয়েছে ? যতক্ষণ পর্যন্ত শাহজাহানকে ইডি আটক না করছে ততক্ষন এই সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না বলেই দাবি রাজনৈতিক মহলের।