একধাক্কায় বিধায়ক-মন্ত্রীদের ৫০০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব বিরোধীরা
মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সরব হয়েছেন ডিএ আন্দোলনকারীরা। রাজনীতির ইতিহাসে বাংলার কালোদিন বলেও সরব হয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী।

ট্রাইব টিভি ডিজিটাল: পুজোর আগে সুখবর রাজ্যের বিধায়ক-মন্ত্রীদের। ভাতা বাড়ল চার গুণ। একলাফে ৪০ হাজার টাকা বেতন বৃদ্ধি হয়েছে মন্ত্রী-বিধায়কদের। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় 'পশ্চিমবঙ্গ দিবস' পালন নিয়ে আলোচনা পর্বের শেষে বিধায়কদের জন্য ৫০০ শতাংশ বেতনবৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে ভাতা বাড়লেও এবার বিধায়ক, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের মূল বেতনও বাড়ানো হয়েছে।
রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ মেটানোর আন্দোলন চলছে। তার মধ্যেই পুজোর আগে কল্পতরু মুখ্যমন্ত্রী। দুর্গোৎসবের মুখেই রাজ্যের বিধায়ক, মন্ত্রীদের বড় উপহার দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বিধায়কদের বেতন প্রায় ৪০ হাজার টাকা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। শুধু তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বলেন, দেশের সব রাজ্যের থেকে বাংলার বিধায়করা সব থেকে কম বেতন পান। তাই সরকারের এই বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন তিনি। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর বিধায়কদের বর্ধিত ভাতা সহ মোট মাসিক বেতনের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ লক্ষ ২১,০০০ টাকা। এরআগে এতদিন বিধায়কদের মাসিক ভাতা সহ বেতন ছিল ৮১, ০০০ টাকা। রাজ্যের পূর্ণ মন্ত্রীদের ভাতা সহ মোট বেতন আগে ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। বৃদ্ধির পর বর্তমান বেতনের পরিমান প্রায় ১ লক্ষ ৫০,হাজার টাকা। একইসঙ্গে রাষ্ট্র মন্ত্রীদের বেতন ভাতা সহ আগে বেতন ছিল ১ লক্ষ ৯ হাজার ৯০০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হল প্রায় ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯০০ টাকা। আর মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরই শোরগোল পড়ে গিয়েছে বিভিন্নমহলে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সরব হয়েছেন ডিএ আন্দোলনকারীরা। রাজনীতির ইতিহাসে বাংলার কালোদিন বলেও সরব হয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী। যেখানে রাজ্য সরকারী কর্মচারীরা মহার্ঘ ভাতা পাচ্ছেন না, বিভিন্ন শূন্যপদ পূরণ হচ্ছে না, সেখানে বিধায়ক, মন্ত্রীদের একধাক্কায় ৫০০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বাম-বিজেপির রোষানলে পড়েছে রাজ্যসরকার। শুধু তাই নয়, বাম আমলে জ্যোতি বসু যখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে টানা ২৩ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি নিজেই সব মিলিয়ে প্রতিমাসে বেতন নিতেন ২৫০ টাকা। সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমের দাবি, বেতন হিসেবে এই ২৫০ টাকাও অতিরিক্ত বলেই মনে করতেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। এমনকি তাঁর ছ'দশকের রাজনীতির ইতিহাসে পশ্চিমবঙ্গের একজন বিধায়ককে মাসিক মোট ৫ হাজার ৫০০ টাকা বেতন দেওয়া হত। যার মধ্যে ২ হাজার ৫০০ টাকা নির্বাচনী ভাতা ছিল। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকেও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বেতন ছিল ২০০ টাকা। এক জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই সময় বিধায়কদের ভাতা বাড়ানো হয়েছিল টেলিফোন, ভ্রমণ ও চিকিৎসা খাতের জন্য। তৎকালীন প্রাক্তন বিধায়কদের পেনশন বাবদ বছরে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত দিত বাম সরকার। এছাড়াও সাইকেল ও টেলিফোন বিল মিলিয়ে সরকার দিত মোট ১৫০০ টাকা। বিধায়কদের রাজ্যের মধ্যে ভ্রমণ ছিল বিনামূল্যে। এবং রাজ্যের বাইরে ট্রেনে ভ্রমণের সময় ১৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ছিল বিনামূল্যে।
শুধু তাই নয়, প্রতি বছর ডাক, বই এবং অন্যান্য খরচ হিসেবে অতিরিক্ত ২০০০ টাকা ভাতা হিসাবে দেওয়া হত। এরপর ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে বাম বিধায়ক, মন্ত্রীদের বেতন আরও কিছুটা বেড়েছিল। সেই সময় একজন পূর্ণমন্ত্রীর বেতন ভাতা সহ মোট বেতন ছিল সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বিধায়কদের বেতন বেড়ে হয়েছিল প্রায় ৭ হাজার টাকা। তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময়েও বাংলার বিধায়ক মন্ত্রীদের সেভাবে বেতনের অঙ্কের পরিমাণ বৃদ্ধি না হওয়ায় তরুণ বিধায়কদের অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে বিধায়ক ও মন্ত্রীদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ২০২৩ সালেও তৃতীয় বারের জন্য বিধায়ক, মন্ত্রীদের বেতন বাড়াল বর্তমান রাজ্যসরকার। আর যা নিয়ে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। বিরোধী দলের বিধায়করাও মুখ্যমন্ত্রীর এই বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
গত কয়েক বছর ধরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ তার দল তৃণমূল কংগ্রেস বারবার অভিযোগ করে আসছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রাজ্যের হকের টাকা আটকে রেখেছে। তার মধ্যে ১০০ দিনের কাজের টাকাও রয়েছে। রাজ্যের কোষাগার শূন্য। সেই টাকা আদায়ে বড় আন্দোলনের পাশাপাশি দিল্লিতে ধর্নায় বসার হুঁশিয়ারি গত ২১ শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বকেয়া ডিএ-এর দাবিতে পথে নেমেছেন রাজ্য সরকারী কর্মচারীরা। এই পরিস্থিতিতে বিধায়ক, মন্ত্রীদের একলাফে এতটাকা বেতন বাড়ানোর রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত অনুচিত বলেই দাবি করছে বিরোধী দলগুলো। এই বিতর্ক এখন কতদূর গড়ায় সেটায় দেখার।