প্রয়াত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার

বাংলার সাহিত্য জগতে ফের নক্ষত্র পতন। প্রয়াত হলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার।

প্রয়াত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার

ট্রাইব টিভি ডিজিটাল: বাংলার সাহিত্য জগতে ফের নক্ষত্র পতন। প্রয়াত হলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। সোমবার ৭৯ বছর বয়সে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন 'অর্জুনে'র স্রষ্টা। পরিবার সূত্রে খবর, গত ২৫ এপ্রিল COPD-এর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। টানা ১৩ দিন লড়াইয়ের যবনিকা পতন হয় সোমবার বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে। 

অনিমেষ চতুষ্ক সমরেশ রচিত চারটি অবিস্মরণীয় উপন্যাস। উপন্যাসগুলি হল ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ এবং মৌষলকাল। কালবেলা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। এদিন তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বাংলার সাহিত্য জগতে। গত ১২ বছর ধরেই সিওপিডি-তে আক্রান্ত ছিলেন লেখক। সূত্রের খবর, গত ২৫ এপ্রিল তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় শেষ ৩ দিন তাঁকে রাখতে হয়েছিল ভেন্টিলেশনে। 

১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার পান তিনি। ১৯৮৪ সালে কালবেলা উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান তিনি। এছাড়াও বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন।  চিত্রনাট্য লেখক হিসাবে জয় করেছেন বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির এওয়ার্ড। সমরেশ কলকাতা ও বাংলাদেশএর সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে পাঠকমন জয় করেছেন।

১৯৭৫ সালে তাঁর প্রথম  সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস “দৌড়” প্রকাশ পায়।  তিনি শুধু তাঁর লেখনী গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস লেখনীতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকদের আন্দলিত করে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি। 

১৯৪২ সালে উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম উত্তরাধিকার, কালপুরুষ, কালবেলা-সহ বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাসের লেখক সমরেশের। প্রাথমিক শিক্ষা জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে। ষাটের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা বিভাগের (সাম্মানিক) স্নাতক স্তরে । এর পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিপ্লব, সংগ্রাম ও জীবনকে অন্যভাবে যাপনের কাহিনী কখনও তিনি ছেড়ে যাননি। তাঁর ‘গর্ভধারিনী’ উপন্যাস কার্যত বৈপ্লবিক।

সমাজতন্ত্র, সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হিমালয়ের কোলে, সান্দাকফু পেরিয়ে এক বরফঢাকা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর উপন্যাসের তরুণ চরিত্রদের। গোয়েন্দা-গল্পেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর লেখা অর্জুনের গল্পে বিভোর থেকেছে আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীর পাঠকরা।
বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কম নেই। 

ফেলুদা, কাকাবাবু, ব্যোমকেশ সকলেই স্বকীয়ভাবে বিরাজ করছেন আজও। কিন্তু সবাই কলকাতায় থাকেন। রহস্য ধরতে হিল্লিদিল্লি যান। সেখানে সমরেশের গল্পের গোয়েন্দা, তথা, সত্যসন্ধানী অর্জুন জলপাইগুড়ির ছেলে। কলকাতাতেও কেস সলভ করতে এসে এসেছে। কিন্তু তার আসল জায়গা জলপাইগুড়ি। মফঃস্বল শহর, তার মানুষ, জলপাইগুড়ির আশেপাশে তিস্তা, তোর্সা, করলা ইত্যাদি নদী ছাড়িয়ে জলদাপাড়া,মাদারিহাট, বীরপাড়া, মালবাজার, রাজাভাতখাওয়া, হলং, গরুমারা ইত্যাদি ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গলে আর চা বাগানে ঘেরা এক প্রাকৃতিক পরিবেশে গজিয়ে ওঠে নানা ভয়ানক রহস্য। 

‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’, ‘খুনখারাপি’, ‘কালিম্পং-এ সীতাহরণ’ ইত্যাদি গল্পে দুরন্ত রহস্য সমাধান করে অর্জুন। তার লাল মোটরবাইক কার্যত এক ‘আইকনিক’ অংশ হয়ে ওঠে গল্পের। সমরেশ অর্জুনকে বাংলাতেই আটকে রাখেননি। নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকাতে, অর্জুন কেস ধরেছে একেবারে নিউ ইয়র্ক সিটিতে। উত্তরবঙ্গের সমস্ত সৌন্দর্য, আবেগ, রহস্য ধরা দিত তাঁর কলমে। কলকাতাবাসী বহু পাঠক তাঁর লেখাতেই চিনেছিল জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা, রূপমায়া সিনেমা, হাকিমপাড়া, শিল্পসমিতিপাড়া, রায়কতপাড়া। দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কাছে হার মেনে অবশেষে উত্তরের আকাশে জ্বলজ্বল করা এক তারার দেশেই চলে গেলেন সমরেশ মজুমদার।